দিকে দিকে ছড়িয়ে দাও “নবপ্রভাত” এর আলোদিকে দিকে ছড়িয়ে দাও “নবপ্রভাত” এর আলো
বাংলাদেশে LGBTQI Movement এর এক গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন চরম ক্রান্তিকাল চলছে। যৌন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার হরণ করার এক মহোৎসব চলছে। আর এই মহোৎসব এর নিরিহ বলি হচ্ছে প্রান্তিক সমকামী ও রুপান্তরকামীরা। উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সমকামী ও রুপান্তরকামী ব্যক্তিরা দেশের বাহিরে কোন নিরাপদ রাষ্ট্রে গিয়ে বসবাসের সু্যোগ পেলেও নিম্নবিত্ত পরিবারের অর্ধ শিক্ষিত ব্যক্তিদের সেই সুযোগ নাই। তাই পরিবার ও সমাজের রোষানলে পড়ে নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছা ও মানবাধীকার চিরতরে হারাচ্ছে। কেউ কেউ নির্যাতিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অকালেই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর পক্ষে সক্রিয়ভাবে দাড়ানোর জন্য কোথাও যেন কেউ নেই। হতাশাগ্রস্ত প্রান্তিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার কারণে যখনই নিজেদের অধিকারের দাবিতে ঘুরে দাড়িয়েছে তখনই একদল লাফিয়ে এসেছে তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য। নানা সময়ে নানা ছলে, বলে, কৌশলে এই জাগরণকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারলেও সেই অপচেষ্টা বার বার ব্যর্থই হয়েছে । ২০১৬ সাল থেকে “সমাজ পরিবর্তন হবে, সমাজ পরিবর্তন হবে” এই বুলি শুনে আসছি আবার আজ ২০২০ সালে এসেও তাদের মুখে একই বুলি শুনছি। কিন্তু কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে এবং আদৌও পরিবর্তন হয়েছে নাকি পিছিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তারা কতটুকুই বা খোঁজ রেখেছেন। বর্তমানে সংকীর্ণ মানসিকতার মৌলবাদীরা অনলাইনে যৌন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার লেখা ছড়িয়ে দিয়েছে , শত শত বই প্রকাশ করেছে, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দিচ্ছে, ভুল তথ্য দিয়ে জনসাধারণকে উস্কানি দিচ্ছে। এগুলোর প্রতিরোধ এবং যোগ্য জবাব দেয়ার মতো কারও কোন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা আছে কি? না, এগুলো প্রতিরোধ করার কোন পরিকল্পনা না থাকলেও কেউ এগুলো প্রতিরোধ করতে দাড়িয়ে গেলে শত শত অপবাদ দিয়ে তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা অনেকেই কষে রেখেছে। ২০১৮ সালে যখন প্রান্তিক যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকারের দাবিকে জোরদার করার জন্য “নব প্রভাত” গঠিত হলো তখন থেকে আজ পর্যন্ত ঘরের শত্রু-বাইরের শত্রুরা মিলে শত সহস্র বার আমার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে চেয়েছে। কখনও আমাকে মেন্টাল প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেছে, কখনও অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির ধুয়া তুলেছে, কখনও বা নাম কমানোর হাস্যকর অভিযোগ তুলেছে। কেউ কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন প্রমাণ নিয়ে আসতে পারে নি। ভেবেছে ইয়াছিনের চরিত্রে দাগ লাগাতে পারলেই তার হাতে গড়া “নব প্রভাত” ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু তারা ভুলেই গিয়েছিলেন “নব প্রভাত” এর ভিত্তি একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা। এখানে প্রত্যেকের মতামতের যথাযোগ্য সম্মান দেয়ার শিক্ষা দেয়া হয়। তাইতো আজও “নব প্রভাত” দাঁড়িয়ে আছে তার ভিত্তির উপরেই। কিন্তু অপবাদ রটনাকারীরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু কেন আমার বিরুদ্ধে এই অপবাদ রটনা আর কেনই বা “নব প্রভাত” বিরুদ্ধে অপচেষ্টা? আমি তো কখনও কারও পাঁকা ধানে মই দেই নি আর “নব প্রভাত” এর উদ্দেশ্যও গোপন রাখা হয় নি। “নব প্রভাত” এর গঠনতন্ত্রের ৪ নং ধারাতেই ৭ টি মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে।
(৪.ক) নংঃ যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রচার ও প্রসার। এই ধারা বাস্তবায়নের জন্য আমি ব্লগে লিখেছি, পেজে লিখেছি, বিভিন্ন গ্রুপে লিখেছি। সবাইকে লেখার উৎসাহ দিয়েছি। পাঠক কে হবে তা নিয়ে হয়ত অনেকের সাথে মতপার্থক্য তৈরী হতে পারে। কেউ মনে করেন শুধু যৌন সংখ্যালঘুদের মধ্যেই প্রচার হওয়া উচিৎ। কিন্তু আমি মনে করি না এই সীমাবদ্ধতা থাকা উচিৎ। কারণ একটি সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে সবারই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এই চিন্তাধারা থেকেই পাঠকদের হাতে কিছু গঠনমূলক বই তুলে দেয়ার তীব্র প্রয়োজনীতাও অনুভব করি।
(৪.খ) নংঃ যৌন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো দূর করা। এই ধারা বাস্তবায়ন করতেই দুই বছর থেকে প্রায় প্রতি মাসেই কর্মশালার আয়োজন করে এসেছি। বিভিন্ন বিতর্কে অংশ নিয়েছি। যৌন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বাইরের মানুষের মাঝে দাঁড়িয়েও এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। আজ তারই ফলাফল হিসেবে অসংখ্য বিসমকামী মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছি।
(৪.গ) নংঃ যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সমর্থন করে এমন ব্যক্তিদের জন্য কার্যকরী একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলা। এই ধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনলাইন এবং অফলাইনে সমানভাবে প্রচার চালিয়ে এসেছি। অনলাইনে কম সাড়া পেলেও অফলাইনে বিশাল একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি।
(৪.ঘ) নংঃ যৌন সংখ্যালঘুদের মধ্যে অধিকার ও স্বাধীনতা চেতনার বিকাশ ঘটানো। ৯০% যৌন সংখ্যালঘু মানুষ তাদের অধিকার কি এ সম্পর্কেই সচেতন নয়। তাদেরকে সবসময়ই অধিকার সম্পর্কে ধরণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। আজ আমি শুধু একা নই তৈরী হয়েছে একঝাক অধিকার কর্মী। আশা রাখি তাদের হাত ধরেই আরও অধিকার সচেতন মানুষ তৈরী হবে।
(৪.ঙ) নংঃ যৌন সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে কেউ নির্যাতনের শিকার হলে তার পাশে দাড়ানো। অর্থনৈতিক কোন ব্যবস্থা না থাকার কারণে সবাইকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করতে পারি নি কিন্তু সবসময় মানসিক সাপোর্ট দিয়ে এসেছি, বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছি।
(৪.চ) নংঃ দেশীয় ও বৈদেশিক জনমত যৌন সংখ্যালঘুদের পক্ষে আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। এই ধারা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আমরা কাজ করেছি। আমাদের পাশে থাকার জন্য বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সামাজিক নানা কার্যক্রম পরিচলনা করে সমাজকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে আমরা সমাজের বাইরের কেউ নই বরং এই সমাজে আমারাও অবদান রাখতে পারি। দেশের বাহিরের মানুষকে এই দেশে মানবাধিকার বাস্তবায়নের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করানোর চেষ্টা করেছি।
(৪.ছ) নংঃ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বাংলাদেশে নারীদের অধিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সচেতন হলেও যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকারের ব্যপারে একেবারে উদাসীন। আমরা চেয়েছি তাদের সাথে সাংগঠনিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে৷। যাতে বুঝাতে পারি যে যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকার মানবাধিকারেই অংশ। এই ধারাটি খুব বেশি বাস্তবায়ন করতে পারি নি। কারণ যারা মানবাধিকারের কথা বলছে বাস্তব জীবনে তারা নিজেরাও প্রান্তিকদের মানবাধিকার নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী নয়। তবুও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
উপরোক্ত কাজ এবং উদ্দেশ্যগুলো কি সত্যিই খারাপ ছিল? নিরপেক্ষ মানুষগুলো কি এই কাজগুলোকে বাধাগ্রস্ত করত আদা-জল খেয়ে লাগতে পারে? নাকি তাদের স্বার্থে আঘাত লেগে যাচ্ছে? সংকীর্ণ মানসিকতার মৌলবাদীরা কুসংস্কার এবং বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার করণে এই কার্যক্রমগুলোর বিরোধিতা করবে এটা আশ্চর্যের কিছু নয় কিন্তু মানবতাবাদী ও যৌন সংখ্যালঘু অধিকার কর্মীর ধ্বজাধারী কেউ যদি গোপনে একটি সংগঠন ও তার প্রতিষ্ঠাতাদের বিরুদ্ধে এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে সেটাই বরং কলঙ্কজনক। কিন্তু এদের জেনে রাখা উচিৎ “নব প্রভাত” আজ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গেছে, একটি কণ্ঠ থেকে শত কণ্ঠে ছড়িয়ে গেছে। শহর থেকে গ্রামে “নব প্রভাত” এর একদল প্রদিপ তৈরী হয়েছে। যে প্রদিপগুলো প্রতি ঘরে ঘরে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই প্রদিপগুলো জানে তাদের নিজেদের অধিকার লড়াই নিজেদেরই চালিয়ে যেতে হবে। তাই কোন ঝড়-ঝাপটাই তাদেরকে নিভিয়ে দিতে পারবে না বরং সমস্ত বাধা অতিক্রম করেই তারা “নব প্রভাত” এর আলো ছড়িয়ে দেবে জগৎ মাঝে। সেই আলোতেই দূর হবে সমস্ত অন্ধকার, কুসংস্কার, হিংসা, হানাহানি, অত্যাচার।
এগিয়ে যাও হে “নব প্রভাত” এর ভোরের পাখি,
গেয়ে যাও মানবতার বুলি।
একক কণ্ঠে তুমি দূর্বল বটে,
শতকণ্ঠে তুমিই শক্তিশালী।