প্রাচীন ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্যে যৌন বৈচিত্র সম্প্রদায়ের কাহিনী: ৪র্থ পর্ব

লেখক: ইয়াছিন আলী

 

ধারাবাহিক: ৪র্থ পর্ব

রাজা ইল এর লিঙ্গ পরিবর্তন

বাল্মীকি রামায়ণ ও বহ্মপুরাণ এ রাজা ইল এর লিঙ্গ পরিবর্তনের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে । শুধু তাই নয় চন্দ্র দেবের পুত্র বুধ এর সাথে রাজা ইলের স্ত্রী রুপ ইলার বিবাহ এবং একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করার কাহিনীও তুলে ধরা হয়েছে । কাহিনীটি তুলে ধরা হলো:

সেকালে সুর্য্যবংশে, ইল নামে খুব  ক্ষমতাশালী এক রাজা ছিলেন । রাজা ইল শিকার করতে খুব ভালবাসতেন। তিনি একদিন অনেক সৈন্যসামন্ত এবং লোকজন সঙ্গে নিয়ে শিকারের জন্য বনে গেলেন । প্রতিদিন বনে বনে ঘুরে শিকার করতে করতে, তার এতই ভাল লাগল যে রাজধানীতে ফেরার জন্য তার আর ইচ্ছা হল না । তিনি তার লোকদেরকে বললেন-“তোমরা সবাই রাজধানীতে ফিরে গিয়ে, আমার পুত্রকে নিয়ে রাজত্ব কর; আমি কিছু লোক নিয়ে এখানে থেকে, কিছুকাল শিকার করব।” রাজার কথায় সকলেই রাজধানীতে ফিরে গেল । তখন তিনিও বনে বনে শিকার করতে করতে ক্রমে হিমালয় পর্বতে গিয়ে সেখানে বাস করতে লাগলেন। একদিন রাজা দেখলেন, গভীর বনের মধ্যে অতি সুন্দর ঠিক অট্টালিকার মত সুসজ্জিত একটি গহ্বর। এই গহ্বরে যক্ষরাজ সমন্যু ও তাহার স্ত্রী সমা থাকতেন। যক্ষেরা নানারূপ মায়া জানে; সমা ও সমন্যু অনেক সময় হরিণের রূপ ধরে, বনে বনে ঘুরে বেড়াইতেন এবং সে দিন তাঁহা বেড়াতে বের হয়েছিলেন। রাজা ইল জানতেন না যে, সেটা যক্ষের বাড়ি, কাজেই এমন সুন্দর সাজান শূন্য গহ্বরটি দেখে তার লোভ হল; তিনি লোকজন নিয়া সেটাকে দখল করে নিলেন । যক্ষরাজ বন থেকে ফিরে আসলে, রাজার সেই অন্যায় ব্যবহার দেখে খুব রেগে গেলেন । কিন্তু এখন উপায়? ইল রাজাকে ত যুদ্ধ করে জয় করা সহজ নয়! আর, গহ্বরটি ছেড়ে দিতে বললে কি তিনি তা শুনবেন? যক্ষরাজ তখন তার আত্মীয় বড় বড় যক্ষ যোদ্ধাদেরকে ডেকে বললেন, “তোমরা ইল রাজার নিকট হতে যেভাবে পার, আমার গহ্বরটি উদ্ধার করে দাও।” তার কথায়, সকল যক্ষযোদ্ধা মিলে ইলরাজাকে গিয়ে বলল, “শীঘ্রই আমাদের গহ্বর আমাদের ছেড়ে দাও, নতুবা যুদ্ধ করে তোমাকে তাড়েয়ে দেব।”

এ কথায় ইল রাজার খুব রাগ হল, তিনি তখনই যক্ষদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ করে, তাদেরকে পরাজিত করলেন । বেচারি যক্ষরাজ কি আর করেন, স্ত্রীকে নিয়ে মনের দুঃখে বনে বনে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া তার আর উপায় রইল না। এভাবে কিছুদিন যায়, একদিন যক্ষরাজ স্ত্রী কে বললেন “দেখ সমা! নিজের বাড়ি ছেড়ে বনে বনে আর কতদিন ঘুরে বেড়াব? এই অত্যাচারী দুষ্ট রাজাকে ফাঁকি দিয়ে না তাড়ালে তো চলবে না! তুমি এক কাজ কর – সুন্দরী হরিণ সেজে রাজাকে ভুলিয়ে যেভাবে পার একবার যদি তাকে উমা বনে নিয়ে যাও, তাহলেই রাজামশাই জব্দ হবেন। আমি ত আর সেখানে যেতে পারব না, কাজেই তোমাকে এই কাজটা করতে হবে।” এই কথা শুনে যক্ষিণী বলল, “তুমি কেন উমা বনে যেতে পারবে না? সেখানে গেলে সমস্যা কি?” যক্ষরাজ বললেন, “ পার্বতীর অনুরোধে, মহাদেব তার জন্য একটি নির্জ্জন বন প্রস্তুত করে দিয়েছেন। তারই নাম ‘উমাবন’। মহাদেব বলেছেন যে, সেখানে তিনি, গণেশ, কার্ত্তিক, আর নন্দী এই কয়েকজন ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করলে তখনই সে স্ত্রীলোক হয়ে যাবে। এখন বুঝতেই পারছ, সেখানে আমার যাবার সাধ্য নেই।”

এর পর, যক্ষের উপদেশ মত সমা হরিণী সেজে, ইল রাজার সামনে দিয়ে ঘুরতে লাগলেন । তাকে দেখেই রাজার মনে শিকারের লোভ চাপে বসল, তিনি একাই ঘোড়ায় চড়ে হরিণীকে তাড়া করলেন। মায়াবিনী হরিণীও রাজাকে ক্রমে সেই উমাবনের দিকে নিয়ে গেল । এভাবে যখন সে বুঝতে পারল, যে, রাজা উমা বনে প্রবেশ  করেছেন, তখন হঠাৎ সে হরিণীরূপ ছেড়ে পুনরায় যক্ষিণী হলেন, একটা অশোকগাছের তলায় দাঁড়িয়ে রইলেন । এদিকে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে, রাজাও সেই অশোক গাছের নিকটেই এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে যক্ষিণী হাসতে হাসতে বলল, “কি গো সুন্দরী ইলা ! তুমি স্ত্রীলোক হয়ে পুরুষের বেশে একা ঘোড়ায় চড়ে,কাকে খুঁজতেছ?” যক্ষিণী তাকে “ইলা” বলে সম্বোধন করায় রাজার খুব রাগ হল এবং তিনি তাকে ধমক দিয়ে, সেই হরিণীটার কথা জিজ্ঞাস কলেন।  যক্ষিণী বলল, “ইলা ! তুমি রাগ হয়েছ কেন? আমি তো কোন অন্যায় কথা বলি নি” ? ততক্ষণে  চৈতন্য হইল যে, তিনি সত্য সত্যই স্ত্রীলোক হইয়া গিয়াছেন! এখন উপায়? ইলা তখন বিষম ভয় পাইয়া, যক্ষিণীকে এই অদ্ভুত ব্যাপারের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “দোহাই তোমার, সত্য করিয়া বল, কেন আমি স্ত্রীলোক হইলাম। তুমি নিশ্চয় ইহার কারণ জান। তুমিই বা কে, তাহাও আমাকে বল।”

যক্ষিণী বলিল, “আমার পতি যক্ষরাজ সমন্যু হিমালয়ের গহ্বরে থাকেন,আমি তাঁহার পত্নী সমা। আপনি এতদিন যে গহ্বরে আছেন,সেটাই আমাদের বাড়ী। আমিই হরিণী সাজিয়া আপনাকে ভুলাইয়া এই উমাবনে আনিয়াছি। মহাদেবের আদেশ অনুসারে, কোন পুরুষমানুষ এখানে আসিতে পারে না, আসিলেই সে স্ত্রীলোক হইয়া যায়। এইজন্যই আপনি স্ত্রীলোক হইয়াছেন। এখন দুঃখ করিয়া আপনার কোন লাভ নাই। আপনি ক্ষত্রিয় যোদ্ধা এবং সূর্যবংশের উপযুক্ত বীর ছিলেন। কিন্তু আপনার যুদ্ধ করা আর শিকার করা এখন জন্মের মত শেষ হইল। আর তাহার জন্য দুঃখ করিয়া লাভ কি? দুদিন পরে আপনি সেসব কথা ভুলিয়া যাইবেন।”

যক্ষিণীর কথায় ইলা আরও ভয় পাইয়া বলিলেন, “যক্ষিণি! তুমি অনুগ্রহ করিয়া বল,কি করিয়া আমার সময় কাটিবে,আমি কাহার আশ্রয়ে থাকিব।”

যক্ষিণী বলিল, “পূর্বদিকে খানিক দূরেই চন্দ্রের পুত্র মহাত্মা বুধের আশ্রম আছে। বুধ তাঁহার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য প্রতিদিন এই পথ দিয়া যান। তিনি যখন যাইবেন, তখন তুমি তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইও; তিনিই তোমাকে আশ্রয় দিবেন।” ইহার পর একদিন বুধগ্রহ পিতার নিকট যাইবার পথে সুন্দরী ইলাকে দেখিয়া বলিলেন, “হে সুন্দরী! তুমি একাকী এই বনে কী করিয়া আসিলে? তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে তো আমার সঙ্গে চল, আমি তোমাকে আমার রানী করিয়া রাখিব। ইলা সন্তুষ্টচিত্তে সম্মত হইয়া বুধের সঙ্গে গেল, বুধও তাহাকে বাড়ীতে লইয়া গিয়া বিবাহ করিলেন। কিছুকাল পরে ইলার পরম সুন্দর একটি পুত্র জন্মিল। অনেক মুনি এবং দেবতা তাহাকে দেখিবার জন্য সেখানে আসিলেন। জন্মিবামাত্রই সে শিশু উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিতে লাগিল। তাহার এইরূপে “পুরু” অর্থাৎ উচ্চ রব শুনিয়া দেবগণ তাহার নাম রাখিলেন পুরূরবা। পুরূরবা দিন দিন বড় হইতে লাগিল; বুধ নিজে তাহাকে অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি নানা রকমের বিদ্যা শিখাইলেন। ইলা যদি তাঁহার পূর্ববকার সমস্ত কথা ভুলিতে পারিতেন, তবে তাঁহার এক্সদুঃখের কোনই কারণ থাকিত না। কিন্তু সে সকল কথা তাঁহার মনে জাগিয়া রহিল। বড় হইয়া পুরূরবা দেখিলেন,তাঁহার মা অনেক সময় মলিন মুখে বসিয়া বসিয়া কি জানি ভাবেন। একদিন মাকে এইরূপে চিন্তা করিতে দেখিয়া, পুরূরবা জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! তুমি সময় সময় মুখখানি মলিন করিয়া কী চিন্তা কর? কিসের জন্য তোমার এত দুঃখ? তুমি আমায় বল কিসে তোমার দুঃখ দূর হইবে, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।” ইলা বলিলেন, “বাবা তোমার পিতা বুধ সকলেই জানেন; তাঁহাকে গিয়া জিজ্ঞাসা কর, তিনিই তোমাকে উপদেশ দিবেন।” পুরূরবা তখন পিতার নিকট গিয়া তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিয়া উপদেশ চাহিলেন। বুধ বলিলেন, “পুরূরবা, ইলার পূর্ব্বকথা সবই আমার জানা আছে। বিপুল রাজ্যের অধীশ্বর মহারাজ ইল, উমাবনে প্রবেশ করিয়া, মহাদেবের শাপে সকল হারাইয়া, এখন অসহায় স্ত্রীলোকরূপে সংসার বাস করিতেছেন। তুমি গোতমিগঙ্গায় স্নান করিয়া, মহাদেব এবং পার্বতীর বিধিমতে পূজা কর। তাঁহাদের অনুগ্রহ হইলেই এ শাপ দূর হইতে পারে। নতুবা আর কোন উপায় নেই।”

পিতার উপদেশে পুরূরবা গোতমিগঙ্গায় চলিলেন, ইলা এবং বুধও তাঁহার সঙ্গে গেলেন। গোতমিগঙ্গায় স্নান করিয়া, তিনজনে মহাদেব ও ভগবতীর  আরাধনা করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের কঠোর তপস্যায়ে সন্তুষ্ট হইয়া, মহাদেব ও পার্বতী তাঁহাদিগকে দেখা দিয়া বলিলেন, “তোমাদের পূজায় আমরা অতিশয় তুষ্ট হইয়াছি। এখন কি বর চাও বল-তাহাই তোমাদিগকে দিব।” পুরূরবা বলিলেন, “প্রভু! ইল রাজা না জানিয়া আপনার বনে প্রবেশ করিয়াছিলেন; তাঁহাকে আপনি ক্ষমা করিয়া শাপ হইতে মুক্ত করুন।” মহাদেবের মত লইয়া ভগবতী বলিলেন, “তথাস্তু, ইলরাজা এখন গোতমিতে স্নান করিলেই, তাঁহার পূর্ব্বমত রূপ লাভ করিবেন।” পার্বতির কথায়, ইলা গৌতমিগঙ্গায় ডুব দিয়া মাথা তুলিবামাত্র, সকলে দেখিল ইলা আর নাই, তাহার স্থানে সশস্ত্র মহারাজ ইল যোদ্ধৃবেশে জল হইতে উঠিয়া আসিলেন। সেই অবধি সে স্থানের নাম হইল ‘ইলাতীর্থ’।

প্রাচীন ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্যে যৌন বৈচিত্র সম্প্রদায়ের কাহিনী: ৩য় পর্ব