প্রাচীন ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্যে যৌন বৈচিত্র সম্প্রদায়ের কাহিনী: ১ম পর্ব

লেখক: ইয়াছিন আলী

 

পৃথিবীর নানা দেশের নানা সভ্যতার প্রাচীন সাহিত্য ও পৌরাণিক কাহিনীতে যৌন বৈচিত্র সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত রয়েছে । ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্যগুলোও এর ব্যতিক্রম নয় । রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ও লোককথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু কাহিনী । বিস্তর ঘাটাঘাটি, দীর্ঘ সময়ের পড়াশুনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এই কাহিনীগুলোকে একত্রিত করে একটি ধারাবাহিক রুপ দেয়ার চেষ্টা করেছি । যৌন বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠিকে নিয়ে বাংলা ভাষায় এই কাহিনীগুলো বেশ অপ্রতুল । তাই আমি আশা রাখি আমার এই ধারাহিক সিরিজ বাংলা ভাষা-ভাষী সাধারণ পাঠক, লেখক, গবেষক, সমাজকর্মী, সাহিত্যিক ও যৌন বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীসহ সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য ও বিশেষ সংগ্রহের মর্যাদা পাবে ।

অর্জুনের বৃহন্নলা রুপ

বিশাল এক কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে মহাভারত। অনেকে একে ইতিহাস গ্রন্থ বললেও তা রীতিমতো বিতর্কিত । যাই হোক এই গ্রন্থ মূলত কৌরব ও পান্ডবদের উত্থান,পতন, যুদ্ধ নানা বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে । এই গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে অর্জুন । বাসুদেব শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গেও তার গভীর সম্পর্ক দেখা যায় এই গ্রন্থে । শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে তার বিশ্বরূপ দর্শন করান। অর্জুন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে বাসুদেব শ্রী কৃষ্ণ তাকে যে উপদেশ প্রদান করেন তাই হচ্ছে সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্ম গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা । অর্জুন হচ্ছে পঞ্চপান্ডবের একজন। তাকে ইন্দ্রপুত্রও বলা যায় ।

ধূর্ত শকুনি মামার প্ররোচনায় পান্ডবরা পাশা খেলায় কৌরবদের কাছে হেরে যায় । সব হারতে হারতে শেষে স্ত্রী দ্রৌপদীকেও হারায় । কৌরবদের সভায় দ্রৌপদীকে বস্ত্র হরণ করে অপমাণ করার চেষ্টা করে । শ্রী কৃষ্ণ তাকে রক্ষা করেন । অবশেষে কৌরবরা পান্ডবদের ছেড়ে দেয় কিন্তু শর্ত দেয় বার বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে এবং এক বছর অজ্ঞাত বাসে থাকতে হবে । তার পরেই রাজ্যের শাষণভার ফেরত পাবে। অজ্ঞাত বাসে থাকার সময় ধরা পড়লে শাস্তির মেয়াদ আবার বাড়বে । পান্ডবদের বনবাস যাত্রা শেষ হয়ে আসতে থাকলেও তারা বুঝতে পারল যুদ্ধ ছাড়া কৌরবদের কাছ থেকে রাজ্য ফেরান সম্ভব নয় । তাই অর্জুন স্বর্গে তার পিতা ইন্দ্রের কাছে দিব্যাস্ত্র লাভের জন্য যান। ইন্দ্র তাকে মহাদেবের আরাধনা করতে বলেন । অর্জন স্বর্গে থাকার সময় ইন্দ্রের আদেশে চিত্রসেন অর্জুনকে সংগীত ও নৃত্য শেখান। নৃত্যরত অবস্থায় অর্জুন স্বর্গীয় অপ্সরা উর্বশীর দিকে বার বার তাকান । উর্বশী অর্জুনের এই তাকানোকে কামনা ভেবে এক সময় প্রেমের প্রস্তাব দেয় কিন্তু অর্জুন তা প্রত্যাখ্যান করেন । কামনার বশে নয় বরং কুরু বংশের মাতা হিসেবে তার দিকে তাকিয়েছেন, এটা জানিয়ে দেন । মাতা সম্মোধন করায় উর্বশী লজ্জা এবং অপমানিত বোধ করেন । যার ফলে অর্জুনকে অভিশাপ দেন যে, এক বছর তাকে নর্তকী হয়ে স্ত্রী লোকদের মাঝে নপুংসক হয়ে থাকতে হবে । বনবাস শেষে অজ্ঞাত বাসের সময় বিরাট রাজের মহলে অন্যরা বিভিন্ন বেশ ধারণ করলেও অর্জুনকে নপুংসক নর্তকী রুপে রাজ সভায় নাচ শেখাতে হয় । এই সময় অর্জুন বৃহন্নলা রুপে রাজকুমারী উত্তরাকে নাচ শেখান । এই রাজকুমারী উত্তরার সাথে পরবর্তীতে অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুর বিবাহ হয় । যা কুরু-পান্ডবদের যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে । অজ্ঞত বাস শেষ হওয়ার বছরে কুরু যুবরাজ দূর্যধন মহারাজ বিরাটের মৎস রাজ্য আক্রমণ করেন । বিরাট রাজের জন্য এই আক্রমণ মোকাবেলা করা ছিল অসম্ভব ব্যপার । যুবরাজ দূর্যধন বিরাট রাজের গরুর পাল হরণ করেন । অবশেষে বাধ্য হবে বিরাট রাজার পুত্র মৎস রাজ্যের যুবরাজ উত্তর বৃহন্নলারুপী অর্জুনকে সারথী হিসেবে নিয়ে যুদ্ধে গমন করেন । কিন্তু কুরু সৈন্য দেখে সে ভয়ে পালাতে শুরু করে । তখন রথের সারথী বৃহন্নলা যুবরাজ উত্তরকে রথের সারথী করে নিজের যুদ্ধ করা শুরু করেন । এতে একে একে সব কুরু যোদ্ধা পরাজিত হতে থাকে এবং বৃহন্নলা মৎস রাজ্যকে এই যুদ্ধের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে ।  এভাবেই বৃহন্নলা রুপে তার অভিশাপ (আশির্বাদ হিসেবে কাজে লাগে) খন্ডন হয় ।